মুত্তাকিন হাসান
ছোট বেলায় সমাজ বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে সমাজের কত সংজ্ঞাই না পড়েছি। পড়েছি শুধু পরীক্ষার খাতায় নাম্বার পাওয়ার আশায়। কখনো কি এর মর্ম কথা বুঝতে চেষ্টা করেছি। অন্যরা করলেও আমি এক হরফও করিনি। তাছাড়া, আমার মতো ছাত্রের কাছে মর্ম বুঝা কল্পনাতীত। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে এখন কিছুটা বুঝতে পারি- সমাজ কি। সাধারণ ভাবে আমরা বলতে পারি- দুই বা ততোধিক মানুষের মাঝে যে পারস্পারিক সম্পর্ক তাই সমাজ।কোন না কোন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বহু লোকের সংঘবদ্ধ বসবাস।সমাজের এসব সংজ্ঞা শুধু পাঠ্য পুস্তকেই দৃশ্যত।বাস্তবিকভাবে কালের প্রবাহে হারিয়ে যাচ্ছে এ সব সংজ্ঞা। আমরা এখন এমন এক অবস্থায় উপনীত হয়েছি, যেখানে শুধু ব্যক্তি নয় ধ্বংসের মুখে আমাদের সমাজ। মনুষ্যত্ব হারিয়ে আজ আমরা শুধুমাত্র প্রাণী বিশেষ। মানুষ ছাড়াও ইতর প্রাণীর ক্ষেত্রেও সমাজের অস্তিত্ব দেখা যায়।কিন্তু আমাদের সমাজ থেকে সে সমাজ আলাদা। যেহেতু আমরা কাঠামোবদ্ধ, তাই আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা আদর্শই হওয়া উচিত, তা না হলে ইতর প্রাণীর সাথে আমাদের কোন তফাৎ থাকবে না।সমাজের সাথে মূল্যবোধ কথাটা খুবই ঘনিষ্ট। মূল্যবোধ হলো রীতিনীতি ও আদর্শের মাপকাঠি; যা সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়।
মূল্যবোধ মানুষের ভিতর ভালো-মন্দের মধ্যে একটা স্পষ্ট পার্থক্য গড়ে দেয়। সুতরাং ভিত্তি যদি নড়বড়ে হয়ে যায়, তাহলে সে সমাজ বা রাষ্ট্রের অনেক কিছুতেই ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। তারই প্রমাণ বর্তমানে সভ্যতার আড়ালে অসভ্যতা দোলা দিচ্ছে। সম্প্রতি খবরাখবর পর্যালোচনা করলে কিশোর গ্যাং আর তারুণ্যর বেখেয়ালি স্বভাব এলোমেলো করে দিচ্ছে এ সমাজকে। এ দায় কি শুধুই রাষ্ট্রের ? পরিবার বা সমাজের কোনো দায়িত্ব নেই। ধানমণ্ডিতে আনুস্কার ঘটনার পর আবার ঘটলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর মাতাল উম্মাদনা ও ধর্ষণ এবং অতঃপর মৃত্যু। কতিপয় এ ঘটনা সাধারণ অভিভাবকদের দিন দিন ভাবিয়ে তুলছে।

বর্তমানে সমাজের ঐক্য, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য যেন অন্যায় অত্যাচারের ধুলোয় ঢাকা পরে আছে। সমাজের যে বর্তমান হালহকীকত তাতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যে কি হবে, তাহা মহান সৃষ্টিকর্তা জানে।নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য খেই হারিয়ে ফেলছে অনেকেই। আধুনিকায়ন করার নিমিত্তে সমাজকে আমরা অনেকভাগে ভাগ করেছি- সুশীল সমাজ, কৃষক সমাজ আরো কত কিছু। সমাজতো একটাই- সেটা মানব সমাজ অর্থাৎ আমরা সবাই মানুষ। আমরা বর্তমান যে সমাজে বাস করি, সেখানে এখন উচিত কথার ভাত নাই। উচিত কথা বলতে গেলেই -হয় সে পাগল তা না হয় গোঁ মূর্খ-কিছুই বুঝে না। এ অসংলগ্ন সমাজে ভালো মানুষরাও ধীরে ধীরে খারাপ পথে পা বাড়াচ্ছে। কেউ লোভে পরে, আবার কেউ বাধ্য হয়ে। সমাজে দুই ধরণের খারাপ মানুষ রয়েছে। প্রথমত, যারা প্রকৃতিগতভাবেই খারাপ অর্থ্যাৎ পরিবার থেকেই খারাপ শিক্ষা নিয়ে বড় হয়েছে । দ্বিতীয়, যারা ভালো মানুষ অর্থ্যাৎ পারিবারিকভাবেই কোনো সৎ পরিবারে বড় হয়ে উঠা মানুষ। কিন্তু পারিপার্শ্বিক চাপে তারা খারাপ হয়েছে। তবে এনাদের সংখ্যা একটু কম। তবুও এই দুই শ্রেণির মানুষের কারণেই সমাজ এখন বেতাল।
কথায় আছে ভালো হতে পয়সা লাগে না। ভালো মানুষ হওয়াটা নিজের উপলব্ধি আর পরিবেশের ওপর নির্ভর করে । মায়ের ভাষা যেমন কাউকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শেখাতে হয় না তেমনই সৎ বা ন্যায়বান হতে কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। একটি শিশু জন্মের পর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ অনুযায়ীই বেড়ে উঠে। শিশুটি যদি আরব কোনো দেশে জন্মে তাহলে সে আরবি বলবে, ইংরেজি ভাষার কোনো দেশে জন্ম নিলে ইংরেজি বলবে, এটাই স্বাভাবিক। ঠিক একইভাবে কোনো শিশুর জন্ম যদি ঘুষখোর ন্যায়নীতিহীন দুর্নীতিবাজ কোনো মানুষের ঘরে হয় তাহলে সেও বড় হয়ে ন্যায়বিবর্জিত মানুষ হবে। মূল্যবোধ ও ন্যায়নীতির অনুভূতি প্রথম আসে পরিবার থেকে। পরিবারই হলো একজন মানুষের প্রথম এবং সর্বোত্তম শিক্ষালয়। আর দ্বিতীয় ধাপ হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাঙ্গন। সুতরাং পরিবারের মানুষজন যদি ভালো হয় সেই পরিবারের সন্তানরাও ভালো হবে। একসময় স্কুলে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি নৈতিকতা, আদর্শ, আচার-আচরণ শেখানো হতো। এখন প্রায়ই দেখা যায় শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীর যৌন হয়রানির ঘটনা। শিক্ষক যেখানে এ রকম কুকর্মে লিপ্ত থাকেন, সেই শিক্ষকের কাছ থেকে নৈতিকতা শেখার কোনো সুযোগ নেই। অভিভাবকরা আছেন সবচেয়ে বেশী চিন্তিত। সামাজিকতা বজায় রাখতে ছেলেমেয়েদেরকে একে অপরের সাথে মিশতে হবে। কিন্তু এ সহজ মেলেমেশা কঠিন হলেই অভিভাবকদের পোহাতে হয় অস্থিরতা। তাই বলা যেতে পারে এ অস্থিরতা মুক্তির একমাত্র পথ পরিবার বা অভিভাবকদের সতর্ক থাকা।
সমাজের প্রধান উপাদান যেহেতু ব্যক্তি। তাই সমাজের আদর্শ বা চেতনা যত সুন্দরই হোক, যদি সেই আদর্শ অনুযায়ী ব্যক্তিগঠন না করা হয়, তাহলে আদর্শ সমাজ গঠনের স্বপ্ন অসঙ্গতির ধুলোয় মলিন হয়ে যাবে।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও মানবসম্পদ পেশাজীবী