in

ব্যক্তিগত সার্থকতা বলতে কিছু নেই

মুত্তাকিন হাসান

মানুষের ব্যক্তিগত সার্থকতা বলতে কিছু নেই। ব্যক্তির সার্থকতা সমাজকে কেন্দ্র করেই। আমি নিজে গাড়ীর বহর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, থাকছি অট্টালিকা, আধুনিক কোনো রেস্টুরেন্ট খাওয়া- দাওয়া হচ্ছে। আপনি হয়তো নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যেই সব করছেন এবং সমাজবদ্ধভাবে বসবাসও করছেন। কিন্তু ভাবছেন না একে অপরের কল্যাণের কথা। এর অর্থ আপনি আপাত দৃষ্টিতে সামাজিক জীব হিসেবে পরিচিত হলেও আসলে খোলস পরেছেন মাত্র। আর এ কারনেই শিক্ষার অগ্রগতি সম্পন্ন আধুনিক এই সময়ে শ্রেণিবৈষম্যের দৌড়ত্বে সমাজের নাকাল অবস্থা। এখানে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো তারা সব ধরণের সুযোগ ভোগ করছে আর যারা গরীব অসহায় তারা ভাগ্যের দোহাই দিয়ে কোনো রকমভাবে বেঁচে থাকার প্রার্থনা করে। এতে করে তারা নিজেকে ও নিজের পরিবারকে ঘিরে আত্মকেন্দ্রিকতার এক সংকীর্ণ গণ্ডি তৈরি করে। সমাজ নিয়ে বৃহৎ চিন্তা তাদের নাই। তাই যাদের সামর্থ্য আছে, নিজেকে আর্থিকভাবে সার্থক বা সফল ব্যক্তি মনে করে সমাজ বিনির্মাণে তাদের এগিয়ে আসতে হবে।

সমাজ কারো একার নয়। সমাজ বলতে মূলত এমন এক ব্যবস্থা বোঝায়,যেখানে একাধিক চরিত্র একত্রে কিছু নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠা করে একত্রে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলে। তাই ভাবতে হবে চারপাশের মানুষকে নিয়ে। গড়ে তুলতে হবে বসবাসের এক উপযোগী পরিবেশ। শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকলে সমাজের কোনো পরিবর্তন আসবে না। সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের জীবনের ব্যক্তিগত সার্থকতা নিয়ে যে ব্যস্ত সময় আপনি আমি পার করছি তা একপ্রকার অর্থহীন মোহ ছাড়া আর কিছু নয়।

দার্শনিক পিথাগোরাস  বলেছেন,আমাদের জীবন আমাদের ইচ্ছার ওপর চলে না,জীবন মূলত আমাদের কর্মের ওপর দণ্ডায়মান। ইচ্ছার উপর জীবন অনিয়ন্ত্রিত। জীবনের রং বদলাতে সময় লাগে না। যে ব্যক্তি একসময় নাচ, গান আর সিনেমায় পাগল। সময়ের প্রয়োজনে সে হতে পারে ধার্মিক। এক সময়ের এক রানা মাস্তান এখন শামসুল হক যিনি ধর্মের শান্তির বাণীর কথা বলে বেড়ান। সে বুঝতে পেরেছে কর্মই তার জীবন। সৃষ্টিকর্তা আমাদের একটা নির্দিষ্ট সিলেবাসের আওতায় এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এই সিলেবাসের ভিত্তিতে আমাদের কাজ কর্ম যেমন হবে তেমন ফল আমরা পাবো।  তাই বাঁচতে হবে ক্যালেন্ডারের পাতা দেখে নয়। ক্যালেন্ডারের পাতা দেখে আমরা ধুমধামের সাথে জন্মদিন পালন করছি। কিন্তু বিগত বছরে আমরা মানুষের জন্য, সমাজের জন্য কি করেছি একটিবারও ভাবিনা। আসলে মানুষের জীবনের প্রতিটা বছর অতিবাহিত হওয়ার অর্থ হিসাবের খাতার পাতায় নিজের নামকে দীর্ঘায়িত করা।   

আমাদের সবাইকে এই ইহজাগতিক মোহকে ত্যাগ করতে হবে। এটাই চিরন্তন সত্য। তবুও আমাদের দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার চেয়ে প্রার্থিত আর কিছু নেই।সকলেই বেশি দিন বাঁচতে চায়,সকলেরই কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা এক দীর্ঘায়িত জীবন। অসীমতায় যে চৈতন্যময় ক্ষুদ্র পর্যায়টি যা জীবন নামে পরিচিত তার সার্থকতার সঠিক মূল্যায়ন আমরা কিভাবে করবো- কে আমরা তা ভেবে দেখি। এ জীবনের মূল্যায়নের একমাত্র মাপকাঠি হলো  কর্ম, যে কর্ম  আমাদের সমাজের সাথে নিবিরভাবে জড়িত। কারন মৃত্যুর মৃত্যু হলেও কর্মের মৃত্যু নেই। আপনি যে কাজ করবেন তা আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে। যতদিন এই পৃথিবীর অস্তিত্ব আছে ততদিন আপনি সমাজের মানুষের কাছে বেঁচে থাকবেন। আইনস্টাইন মরে গিয়েও তার চিন্তার মাধ্যমে বেঁচে আছেন আমাদের কাছে। বস্তুত, এই যে আইনস্টাইনকে নিয়ে আমরা এত মাতামাতি করছি, নজরুলের বিভিন্ন বার্ষিকী পালন করছি সাড়ম্বরে, তাকে শ্রদ্ধা জানানোর কথা বলছি, এতে ঐ মানবদের আসলেই কিছু এসে যায় না, কারণ তারা এই সম্মান, ভালোবাসা দেখতেও পাচ্ছেন না, ভোগ করতেও পারছেন না। তাই আইনস্টাইনের বা নজরুলের বেঁচে থাকা বলতে তাদের চিত্র জীবিত মানুষের চিন্তা চেতনায় বেঁচে থাকা বোঝায়। তাদের ব্যক্তিগত সার্থকতা নয়, তারা সমাজের জন্য সার্থক বলেই তারা আজও বেঁচে আছে।

মানুষ সামাজিক জীব। সভ্যতার অনুপস্থিতি থাকলেও আদিকালে নির্দিষ্ট কোনো ঘর বাড়ি বা নিজস্ব কোনো সহায়- সম্পদ শিক্ষা জ্ঞানহীন  মানুষ দলবদ্ধভাবেই জীবনযাপন করে আসছিলো।তবে মানুষের মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে নীতিবোধ ও মানবতা জাগ্রত না থাকলেও পরস্পরের প্রতি ছিলো সহানুভূতিশীল। অথচ এই সভ্য সমাজে এসে মানুষের অপকর্ম আর শ্রেনিবৈষম্যে হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ নামের কাঠামো। অভাব দেখা দিয়েছে সত্যিকারের ভালো মানুষ। আজ যাদের আশায় সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে তাকিয়ে আছি তার বেশীরভাগই মুখোশধারী ভালো মানুষ। এরা সমাজের  অগ্রগতির পরিবর্তে  ক্ষমতা আর সম্পদের অপব্যবহার করে  সমাজকে করেছে কোণঠাসা। নিজেদের ব্যক্তিগত সার্থকতা আর সফলতা খুঁজতে সামাজিক জীব হিসেবে সমাজের জন্য যে নিজেকে অর্থবহ করতে হবে তা আমরা বেমালুম ভুলে যাই।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও মানব সম্পদ পেশাজীবী

বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে কেন স্কুল-কলেজ?

আপন জুয়েলার্সের মালিকের বিরুদ্ধে চার্জশিট