বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) নিজস্ব অর্থায়নে দুটি অত্যাধুনিক বাল্ক ক্যারিয়ার সংগ্রহের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। রবিবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ক্রিস্টাল বলরুমে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন।
গত ১২ আগস্ট সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় জাহাজ কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রতিটি জাহাজের ধারণক্ষমতা ৬৩,৫০০ ডেডওয়েট টন (ডিডব্লিউটি)। দুটি জাহাজের মোট মূল্য ৭৬.৬৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯৩৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা), যা দাপ্তরিক প্রাক্কলিত মূল্যের তুলনায় ৪.৬০ শতাংশ কম।
এর আগে, গত ৪ জুন জাহাজ দুটি কেনার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র বিক্রি চলে ১৫ জুলাই পর্যন্ত। ১৬ জুলাই জমা পড়া প্রস্তাবগুলো যাচাই–বাছাই শেষে কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়ন এবং সরেজমিন পরিদর্শন সম্পন্ন হয়। এ সময় ৮টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র ক্রয় করে, এর মধ্যে ৩টি প্রস্তাব জমা দেয়। মূল্যায়ন শেষে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হেলেনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস এলএলসি (Hellenic Dry Bulk Ventures LLC) এর প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। তাদের প্রস্তাবিত চীনে নির্মিত প্রতিটি জাহাজের মূল্য নির্ধারিত হয়েছে ৩৮.৩৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ক্রয় প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা বজায় রাখতে তিনটি উপ–কমিটি গঠন করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। সেগুলো হলো— বিএসসির মহাব্যবস্থাপক (দূরপ্রাচ্য ও পিএইউ) এর নেতৃত্বে দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটি, ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেকের সভাপতিত্বে ৭ সদস্যের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি এবং নির্বাহী পরিচালক (প্রযুক্তি) এর নেতৃত্বে কারিগরি সাব–কমিটি।
প্রস্তাবিত জাহাজগুলোতে রয়েছে উন্নত কারিগরি বৈশিষ্ট্য, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— কন্ট্রা রোটেটিং প্রপেলার যা জ্বালানি খরচ কমায় ও অপারেশনাল দক্ষতা বাড়ায়। এরোডাইনামিক ব্রিজ ডিজাইন যা বাতাসের বাধা কমিয়ে গতি ও জ্বালানি সাশ্রয় করে। আধুনিক হাল ফর্ম ও নো বুলবুস বো যা গতি বৃদ্ধি ও জ্বালানি সাশ্রয় করে। এছাড়াও সিলেক্টিভ ক্যাটালিটিক রিডাকশন সিস্টেম নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশ রক্ষা করে। গ্রিন শিপ কনসেপ্ট জাহাজগুলোকে পরিবেশবান্ধব করে তুলেছে। তাছাড়াও আইএমও টিয়ার-III সার্টিফাইড ইঞ্জিন যা আন্তর্জাতিক পরিবেশগত মানদণ্ড পূরণ করে। এছাড়াও ইউরোপীয় ও জাপানি যন্ত্রপাতি দিয়ে জাহাজগুলো নির্মিত হয়েছে। প্রধান ইঞ্জিন জার্মান লাইসেন্সে তৈরি ম্যান-বি&ডব্লিউ (MAN-B&W), পাম্প স্পেনের এবং কম্প্রেসার নরওয়ের তৈরি।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেক জানান, নতুন দুটি আধুনিক বাল্ক ক্যারিয়ার যুক্ত হলে বিএসসির বহরে পরিবহন সক্ষমতা প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার ডিডব্লিউটি বাড়বে। এ ছাড়া জাহাজ দুটির মাধ্যমে প্রতি বছর ১৫০ জন নাবিকের কর্মসংস্থান হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এ উদ্যোগ দেশের সমুদ্রবাণিজ্যে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করবে।
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) তার ৫৪ বছরের ইতিহাসে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৬০০ কোটি টাকা আয়ের রেকর্ড করেছে। এর মধ্যে নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৩০০ কোটি টাকা, যা কর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠার পর থেকে সর্বোচ্চ মুনাফা।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ জানান, আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে সরকারের অর্থায়নে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনকে (বিএসসি) আরও তিনটি জাহাজ প্রদান করা হবে। তিনি বলেন, সরকার বিএসসির বহরকে সমৃদ্ধ ও আধুনিক করতে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও প্রধান অতিথি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন জানান, নতুন দুটি জাহাজের নামকরণ করা হয়েছে— ‘বাংলার প্রগতি’ এবং ‘বাংলার নবযাত্রা’।
তিনি আরও জানান, একবছরের মধ্যেই সরকার বিএসসিকে স্বতস্ফূর্তভাবে আরও তিনটি জাহাজ দিবে। এবং চীন থেকে জিটুজি তে আরও চারটি জাহাজ অর্জনের প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে বলেও জানান তিনি।